
প্রকাশ: ১১:২২:০০ পিএম, ০৭ এপ্রিল ২০১৮ | |
বিআর রিপোর্ট
হবিগঞ্জের আলোচিত বিউটি হত্যায় জড়িত থাকার কথা আদালতে স্বীকার করেছেন বাবা ছায়েদ মিয়া।
শনিবার পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী জবানবন্দিতে অকপটে মেয়ে হত্যায় নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে।
হবিগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সন্ধ্যায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ সব কথা জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) বিধান ত্রিপুরা বলেন, গ্রাম্য রাজনীতির বলি হয়েছে বিউটি। স্বাধীনতার মাসে সবুজ মাঠে পড়ে থাকা বিউটির লাশের ছবি যে সন্দেহে ভাইরাল হয়, তদন্তে এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পাওয়া গেছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কিছু ভাইরাল হলে মামলা এবং তদন্তে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে।
এসপি জানান, কিশোরী বিউটি হত্যা মামলার বাদী ছায়েদ মিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত হবিগঞ্জ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের আদালতে জবানবন্দি দেন তিনি। পরে প্রতিবেশী এবং ময়না মিয়ার স্ত্রী আছমা আক্তারের বক্তব্যও রেকর্ড করেন আদালত।
এর আগে বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় ধর্ষণ মামলার সাক্ষী বিউটির চাচা ময়না মিয়াকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদেই বেরিয়ে আসে নতুন তথ্য। শেষ পর্যন্ত ময়না মিয়া শুক্রবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডে নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। প্রকাশ করেন জড়িত অন্যদের নামও। হত্যার ঘটনায় বিউটির নানি ফাতেমা বেগম সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এরপর শুক্রবার রাতে একই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন গ্রেফতার বাবুল মিয়া। তিনি প্রথম দফায় বিউটিকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা নেই বলে আদালতকে জানিয়েছেন।
অন্যদিকে বাবুলের মা ইউপি সদস্য কলম চান বিবিকে দু’দিনের রিমান্ড শেষে শুক্রবার রাতে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিউটির মা হুসনে আরা ও বিউটির ভাই সাদেক মিয়া পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।
সাক্ষীদের জবানবন্দির বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, বিউটিকে ধর্ষণকারী বাবুল মিয়া অলিপুরে প্রাণ কোম্পানিতে সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করেন। তার মা ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। ফলে এলাকায় তার অর্থ এবং প্রভাব রয়েছে। তার চরিত্র ভালো ছিল না। এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ইতোপূর্বে বিয়ে করে বাবুল। একই এলাকার ছায়েদ মিয়ার মেয়ে বিউটি আক্তার স্থানীয় মোজাহের উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ত। বাবুলের দৃষ্টি পড়ে তার ওপর। বিউটির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করে তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখায় বাবুল। বাবুল অলিপুর এলাকায় এক হাজার টাকায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত বিউটিকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করে। বাবুল ৯ ফেব্রুয়ারি বিউটিকে প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি দেবে বলে সেখানে নিয়ে যান। খবরটি জানতে পারেন পাশেই আরএফএল কারখানায় চাকরি করা বিউটির মা হুসনা বেগম। তিনি এবং বিউটির বাবা ছায়েদ মিয়া প্রাণ কোম্পানিতে গিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করেন। পরে বিষয়ট জানাজানি হলে এলাকায় সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাবুল বিউটিকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় সালিশে কোনো সমাধান হয় না। পরে বিউটিকে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে তিন দিন রাখা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে অপহরণসহ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন তার বাবা। মামলাটি ৪ মার্চ শায়েস্তাগঞ্জ থানায় এফআইআর করা হয়।
এরই মধ্যে ১২ মার্চ আবারো ইউপি চেয়ারম্যান জজ মিয়ার নেতৃত্বে সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মামলা হওয়ায় কোনো সালিশ হয়নি। ১২ মার্চ বিউটিকে থানায় আনা হয়। পরে মেডিকেল করার পর আদালতে সে ২২ ধারায় জবানবন্দ দেয়। বাবুল মিয়া তাকে বিয়ে করলে মামলা তুলে নেবে বলেও সেখানে জানায়।
বিউটিকে বাড়িতে আনার পর দিশেহারা হয়ে পড়েন বাবা ছায়েদ মিয়া। বাড়িতে না রেখে বিউটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লাখাই উপজেলার গুণিপুর গ্রামে তার নানি ফাতেমা বেগমের বাড়িতে।
এ সুযোগে নতুন করে ফন্দি আটেন ময়না মিয়া। গত ইউপি নির্বাচনে ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ড থেকে সংরক্ষিত নারী আসনের মেম্বার পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার ও বাবুলের মা কলম চান বিবি। কথা ছিল কলমচান বিবি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আসমা আক্তারকে ছাড় দেবেন। শেষ পর্যন্ত কথা না রেখে কলমচান বিবি নির্বাচনে অংশ নেন এবং তার কাছে পরাজিত হয় ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার। এরপর থেকেই উভয় পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ¦ চলে আসছে। এরই জের ধরে বিউটিকে অপহরণের পর ধর্ষণের ঘটনায় মামলায় সাÿী হয় ময়না মিয়া। মামলায় আসামি করা হয় বিজয়ী মেম্বার কলম চান বিবি ও তার ছেলে বাবুল মিয়াকে।
ময়না মিয়া ছায়েদ মিয়াকে প্রায়ই বোঝাতে থাকেন- বাবুল যদি বিউটিকে বিয়ে না করে তাহলে এ নষ্ট মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না। অন্য সন্তানদেরও আর বিয়ে হবে না। এর ছেয়ে যদি বিউটিকে মেরে বাবুল মিয়া ও তার মা কলম চান বিবিকে ফাঁসানো হয় তাহলে প্রতিশোধও নেওয়া হবে এবং তার অন্য সন্তানরা রক্ষা পাবে।
একপর্যায়ে ময়না মিয়ার ফাঁদে পা দেন ছায়েদ মিয়া। ময়না মিয়া ১০ হাজার টাকায় একজন পেশাদার খুনিকে ভাড়া করে এবং আড়াই হাজার টাকা অগ্রীম দেন। ঘটনার দিন রাতে ছায়েদ মিয়া, বাবুল মিয়া ও ভাড়াটে লোক গুণিপুর গ্রামে গিয়ে বিউটির নানি ফাতেমা বেগমকে জানায়, বিউটিকে চেয়ারম্যানের কাছে নেওয়ার জন্য তারা এসেছেন। ওই দিনই লাখাই উপজেলার হরিণাকোন গ্রামে রাত ২টার দিকে বিউটিকে হত্যা করা হয়।
ভাড়াটে ওই লোক বিউটির হাত-পা বেঁধে রাখে আর ময়না মিয়া ছুরি দিয়ে পাঁচটি আঘাত করে হত্যা করে। ঘটনা শুনে ১৭ মার্চ নানি ফাতেমা বেগম বিউটিদের বাড়িতে আসলে তাকে শাসিয়ে দেওয়া হয় কোনো কিছু না বলার জন্য।
পুলিশ সুপার আরো জানান, মেয়ে হত্যার পর একজন বাবার যে অনুভূতি থাকার কথা ছিল তা ছায়েদ মিয়ার চেহারায় ছিল না। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তার এবং ময়না মিয়ার গুণিপুর গ্রামে উপস্থিতির প্রমাণ এবং তাদের আচরণে সন্দেহ হলে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। এর মাঝে ময়না মিয়াকে ৫ এপ্রিল এবং ছায়েদ মিয়াকে ৬ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়।
তিনি বলেন, ভাড়াটে লোকটিকে ধরতে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই সকল পরিকল্পনাকারী এবং হত্যাকারীকে আইনের আওতায় এনে অভিযোগপত্র দাখিল করে বিচার শুরু করা যাবে।
এসপি বলেন, বাবুল মিয়া সরাসরি হত্যায় জড়িত না থাকলেও তার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। অবশ্যই তাকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে মামলার অভিযোগপত্রে রাখা হবে।
![]() Email: [email protected] |