07:47 PM, 10 Apr 2018
তারা যেন লাশ হয়ে বাসায় না ফেরেন

নাজিম উদ দৌলা সাদি

দুপুর আড়াইটা। আগারগাঁও বাংলাদেশ বেতারের পাশ ঘেঁষা ৬০ ফিট রাস্তা পেরিয়ে কেবল শেরে বাংলা নগরের প্রধান সড়কে উঠব। হঠাৎ বিকট শব্দ। পাশে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম।

মোহাম্মদপুর-আব্দুল্লাপুর রুটে চলাচলকারী তেঁতুলিয়া পরিবহনের একটি বেপরোয়া গতির বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেলে থাকা চালকসহ দু’জন মাঝ রাস্তায় ছিটকে পড়লেন। তখনও বাস থামালেন না চালক। পড়ে থাকা মোটরসাইকেলের উপর দিয়ে চালিয়ে দিলেন। এরপর লোকজন জড়ো হয়ে গেলে জানালা দিয়ে চালক ও হেলপার লাফিয়ে বের হয়ে দৌড়ে পালান।

এদিকে পড়ে থাকা দু’জনের মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। দেরি না করে মোটরসাইকেল পাশে রেখে ছুটলাম তাদের উদ্ধারে। আশপাশের লোকজনও যে যার মতো ধরে রিকশায় তুললেন আহতদের। যারা ধরে তুললেন তাদের শরীরেও লাগল ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। নেওয়া হলো পাশের জাতীয় নিউরো সাইন্স হাসপাতালে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ মোবাইলে ছবি ও ভিডিও করলেন।

কয়েকজন মিলে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মোটরসাইকেলটি নিয়ে রাস্তার পাশে রাখলেন। কেউ কেউ আবার ঘাতক বাসটির গ্লাস ভাঙচুর করে মনের ক্ষোভ মেটালেন। আহতদের রিকশায় তুলে আমি আমার মোটরসাইকেলে উঠলাম। ওদিকে অফিসের সময় ইতোমধ্যে অতিক্রম করে ফেলেছে। তারপরও মোটরসাইকেল চালু করতে কেন যেন আর ইচ্ছা করছিল না। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় অনেকটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। বার বার কান দিয়ে পড়া রক্তের স্রোত চোখে ভাসছে, আর গা শিউরে উঠছে। না পারছি অফিসে যেতে, না পারছি বাসায় ফিরতে। তার ওপর আহত দু’জনের জন্য খুব মন খারাপ হতে লাগল। ধীরে ধীরে মোটরসাইকেল নিয়ে গেলাম নিউরো সাইন্স হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখলাম চিকিৎসকরা ব্যতিব্যস্ত। সবাইকে সেখান থেকে বের করে দিচ্ছেন। আমি পেশাগত পরিচয় দেওয়ায় একটু কথা বললেন।

জানতে চাইলাম আহতদের অবস্থা কেমন। চিকিৎসক বললেন, এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আহতদের মধ্যে একজনের কান দিয়ে তখনও অঝরে রক্ত ঝরছিল। অন্যজনের জ্ঞান ছিল। তিনি বিলাপ করছিলেন। যার কান দিয়ে রক্ত ঝরছিল তিনি প্রথমেই অচেতন হয়ে পড়েন। হাসপাতালে গিয়েও অচেতন দেখলাম। কিছুক্ষণ পর অফিসের উদ্দেশে বের হলাম। অফিসে যাওয়া জরুরি। কারণ মঙ্গলবার হওয়ায় দু’একজনের ডে অফ রয়েছে। কিন্তু কেন জানি মোটরসাইকেল চালাতে আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম না। চোখের সামনে এমন দুর্ঘটনা আগে কখনো দেখিনি। অফিসে আসার পথে কতবার যে চোখের সামনে দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্রটি ভেসে উঠেছিল তা গুনে শেষ করা যাবে না। তুলনামূলক ধীরগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে কোনো রকমে অফিসে আসলাম। জানি না, ওই দু’জনের সর্বশেষ অবস্থা। তবে এতটুকুই চাওয়া- মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা যেন ওই দুই পরিবারের জন্য সারা জীবনের কান্না না হয়। তারা বেঁচে থাকুক, সুস্থ হয়ে ফিরে যাক পরিবার-পরিজনের মাঝে। যেভাবে সুস্থ শরীরে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, সেভাবে না হোক; যেন লাশ হয়ে বাসায় না ফেরেন।