
বিআর রিপোর্ট
আমরা প্রায়ই শুনে থাকি ওই ছবি, ভিডিও বা নিউজটা ভাইরাল হয়েছে। এমন কেউ কি রয়েছেন, যিনি কোরিয়ান পপ তারকা সাইয়ের ‘গ্যাংনাম স্টাইল’ গানটি শোনেননি? অথবা তামিল সিনেমা থ্রির সেই বিখ্যাত গান ‘কোলা ভেরি ডি’? এই দুটি গানেরই বেশির ভাগ লিরিকস হয়তো আমাদের প্রায় সবারই মাথার ওপর দিয়ে গেছে। তারপরও কেন এই দুটি গান ভাইরাসের মতো সংক্রমণ করে রেখেছিল আমাদের ফেসবুকের নিউজফিড? সর্বশেষ প্রিয়া প্রকাশ ওয়ারিয়রকে নামে এক মালয়ালম অভিনেত্রীর চোখের ইশারায় ভাইরাল হওয়া ভিডিও। যা কম-বেশি আমরা সবাই দেখেছি।
২০১৭ সালে গুগল, ইউটিউব, ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে, ভাইরাল শব্দটি সেগুলোর মধ্যে একটি। গুগল ট্রান্সলেটরে যার আভিধানিক অর্থ ভাইরাস ঘটিত এবং ব্যবহারিক অর্থ বিষপূর্ণ, বিষাক্ত, দূষিত, দুষ্টু। আজকাল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল শব্দটি প্রচুর ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো তারকার বিয়ের ছবি থেকে শুরু করে হিলারি ক্লিনটনের গোপন ফোনালাপ পর্যন্ত সবকিছুই আজকাল ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে।
ভাইরাল আসলে কী?
কোনো ব্যক্তি বা কোনো বিষয়ের অনুমতি বা স্বত্ব ছাড়া তার সম্পর্কিত ছবি, ভিডিও বা কোনো তথ্য অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়াই ভাইরাল। আজকাল ভাইরাল করা অনেকটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে শুধু পপুলার হওয়া বা খ্যাতি পাওয়ার জন্য নিজেই নিজের ভাইরাল ভিডিও সৃষ্টি করেছে। তবে আমাদের সমাজে ভাইরাল শব্দটি অনেকটা নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। কেউ একটা খারাপ জিনিস করলেই সেটা সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল করে দিচ্ছে। অন্যের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এসে তার সম্পর্কে গোপন তথ্য ভাইরাল করে দিচ্ছে। এমনকি আত্মহত্যার মতো বিষয়টি আজকাল ভিডিও আকারে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। এ তো গেল একশ্রেণি যারা অন্যের দ্বারা ভাইরালের স্বীকার হচ্ছে। আর এক শ্রেণি রয়েছে যারা নিজেরাই নিজেদের ভিডিও ভাইরাল করছে শুধু খ্যাতি পাওয়ার জন্য। এর মাধ্যমে শুধু যে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেগেটিভ ব্যবহার করছে তাই নয়, নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে। অনেকেই নিজের আবেগকে সামলাতে না পেরে এমন সব কাজ করছে, যা আইন ভঙ্গ করছে। যা পরবর্তী সময়ে তার ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলছে।
ভাইরাল যে শুধু নেগেটিভ হতে হবে তা কিন্তু নয়। বর্তমান যুবসমাজ অনেক বেশি সচেতন। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করার নতুন মাধ্যম সৃষ্টি করেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে। যেখানেই অন্যায় দেখছে তা ভিডিও করে বা ব্লগিংয়ের মাধ্যমে ভাইরাল করে দিচ্ছে। যার কারণে সমগ্র জাতির মধ্যে একধরনের সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই কোনো কিছু ভাইরাল করার আগে তার পজিটিভ-নেগেটিভ দুটো দিকই বিবেচনায় আনতে হবে।
ভাইরাল কনটেন্ট
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক তোমার বা আমার কী লাভ রয়েছে ভাইরাল কনটেন্ট সম্পর্কে জেনে। লাভ অবশ্যই রয়েছে। যেমনটি একটু আগেই বলেছি, যেকোনো ধরনের ব্যবসার জন্যই কোনো কনটেন্ট ভাইরাল করতে পারা মানে নিশ্চিত লাভ! আর যদি তোমার ব্যবসায়ের মডেলটিই হয় ইন্টারনেটকে ঘিরে, তাহলে তো কথাই নেই! ধরো, তোমার একটি ই-কমার্স শপ রয়েছে, যেখানে তুমি ছেলেদের টি-শার্ট বিক্রি করে থাকে। একটি ভাইরাল ভিডিও তোমার ব্র্যান্ডকে সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে যেমন পরিচয় করিয়ে দেবে, তেমনি পুরোনো ক্রেতার মস্তিষ্কেরও উপরিভাগে তোমার প্রতিষ্ঠানের নামটিকে অক্ষত রাখতে সহায়তা করবে।
ওয়ার্ড অব মাউথ কী?
ওয়ার্ড অব মাউথ বলতে যেকোনো একটি বিষয়ে একজন ব্যক্তি থেকে অন্য একজন ব্যক্তির কাছে অবাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় তথ্য পৌঁছে যাওয়াকে বোঝায়। যেমন ধরো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নেওয়া একটি উদ্যোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে বেশ আলোচিত হয়েছিল। একটি ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে উদ্যোগটিকে সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তোমরা অনেকেই হয়তো ভিডিওটি দেখে থাকবে। মসজিদের শহর ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এখানে ওখানে মূত্রত্যাগ করার লোকের অভাব হয়নি! সাধারণভাবে বাংলায় লেখা ছিল বলেই হয়তো অনেকে ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেয়নি। অথচ মসজিদ-সংলগ্ন দেয়ালে এ ধরনের কাজ করা রীতিমতো অন্যায়। ধর্ম মন্ত্রণালয় একটা অন্য রকম উদ্যোগ নিয়েছিল। বাংলার পরিবর্তে আরবি হরফে একই কথা লেখা হয়েছিল। ফলাফল ছিল আশাতীত। এই ভিডিওটির পক্ষে এবং বিপক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর আলোচনা হয়েছে। অথচ ধর্ম মন্ত্রণালয় যদি ব্যাপারটি সম্পর্কে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিত তাহলে কি আমরা একই ফলাফল দেখতাম? বলা হয় যে বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় মার্কেটিং, যেমন রেডিওতে অ্যাড দেওয়া, বিলবোর্ড লাগানো বা টিভিসি প্রচার যতটা বেশি কার্যকর, তার থেকেও এই অবাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় পণ্যের খবর ক্রেতা থেকে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া আরও অনেক বেশি কার্যকর। তামিল সিনেমা থ্রির ব্যাপক সাফল্যের পেছনে কিন্তু কোলা ভেরি ডি গানটিই রয়েছে। শুধু অনলাইনেই নয়, বরং অফলাইনেও ওয়ার্ড অব মাউথ মার্কেটিংয়ের কার্যকারিতা অন্য যে কোনো মাধ্যমের থেকে বেশি। যেমন ওমুক রেস্টুরেন্ট রমজানে ফ্রি ইফতার করাচ্ছে এ খবর জানামাত্রই তুমি নিজেও হয়তো অন্তত একজনকে গল্পের ছলে জানাবে অফারটির কথা। তোমার বন্ধুটি তোমার কথা যতটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে, একই কথা বিজ্ঞাপনে দেখলে কি তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত? কখনোই না! বর্তমান যুগে অনলাইনে ডব্লিউ ও এমের ব্যবহার মাত্র ৭%। বাকি ৯৭% ব্যবহারই লক্ষ করা যায় অফলাইনে। ওয়ার্ড অব মাউথ মার্কেটিংয়ের এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণটি হলো আমরা প্রথাগত বিজ্ঞাপনের চেয়ে সব সময় পরিচিত কেউ, যেমন বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনকে বেশি বিশ্বাস করে থাকি। তা ছাড়া একজন ক্রেতা আরও দশজনকে কিনতে উৎসাহিত করতে পারে।
কনটেন্টের ভাইরালিটি কি শুধুই ভাগ্যের খেলা, নাকি অন্য কিছু?
না! ভাইরালিটি কোনো জুয়ার দান নয়। এর পেছনে অবশ্যই কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে। প্রফেসর জোনাহ্ বার্গার এই ফ্যাক্টরগুলোকে একসঙ্গে বলেন STEPPS, যা ছয়টি বৈশিষ্ট্যের একটি লিস্ট। Social currency, Triggers, Emotion, Public, Practical Value ও Stories।
একটি কনটেন্ট এই ছয়টি বৈশিষ্ট্যের যতগুলোর সঙ্গে সন্ধি করবে, কনটেন্টটি ততটাই ভাইরাল হবে। আর যেমনটি আগেও বলা হয়েছে, ভাইরাল কনটেন্ট তোমার ব্র্যান্ড বা পণ্যকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করবে। লাভ কিন্তু দিন শেষে তোমারই।